ওয়ার্কপ্লেসে একটা কথা বেশ প্রচলিত – ‘কনফিডেন্স বাড়াও। কনফিডেন্ট থাকো’। হ্যাঁ, কর্মক্ষেত্রে কনফিডেন্সের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু এটা কি সব সময় দেখানো জরুরি? প্রফেশনালি কিছু বিষয় হ্যান্ডেল করতে হয় একটু টেকনিক্যালি। সত্যিটা হচ্ছে, সব সময় এই কনফিডেন্স দেখালে সেটা কিছুটা নেগেটিভও হতে পারে। আমরা এটা বুঝি বা না বুঝি, আমাদের অবচেতনেই এটা হয়ে উঠতে পারে আমাদের ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকি। কর্মক্ষেত্রে কিছু কিছু আচরণ আছে যেগুলো সব সময় দেখাতে হয় না। আজ আমরা এমনই কয়েকটি আচরণ নিয়ে কথা বলব।
কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে দেয় যে আচরণগুলো
১) আমি এটা করতে পারি না
কাজ করতে গেলে এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, যেখানে আপনি হয়ত কাজ জানেন না। বা কাজটি হয়ত প্রথমবার করতে যাচ্ছেন। কারণ প্রফেশনাল লাইফে এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো আপনাকে প্রথমবারই করতে হয় বা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ফেইস করতে হয় কমফোর্ট জনের বাইরে যেয়ে। এটা খুবই নরমাল ব্যাপার, আপনি যখন একদম নতুন কিছু করতে যাচ্ছেন তখন সেটা শুরু করতে যেয়ে ভয় কাজ করবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে কাজ করবেন না এবং বলবেন যে ‘আমি এটা করতে পারি না’। সাহস সঞ্চয় করে সেই কাজটি আপনাকে করে ফেলতে হবে। নতুন কিছু শিখতে যেয়ে নিজেকে নেগেটিভ মাইন্ডের ভাবা বন্ধ করুন। এতে কখনোই নতুন কিছু শিখতে পারবেন না।
শিখতে যেয়ে মনে হচ্ছে ব্রেক দরকার? তাহলে একটু চিন্তা করে নিন যে ব্রেক নিলে কী কী সমস্যা ফেইস করতে হতে পারে। কিছু সময় ভাবলে বুঝে যাবেন কতটুকু সফলভাবে কাজগুলো করতে পারবেন।
২) এখানে তো সবাই আমার চেয়ে ভালো – আমি পারবো না ভালো করতে
শিক্ষার্থী জীবন শেষ করে হয়ত নতুন জীবনে প্রবেশ করেছেন, অথবা ক্যারিয়ার সুইচ করেছেন। নতুন জায়গায় সব কিছু নতুন লাগছে। আবার এমনও হতে পারে যে নিজের ব্যবসা শুরু করেছেন, সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আপনার মনে হতে পারে, সবাই আপনার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। সবাই অলরেডি ভালো কাজ করছে। আপনি সবার চেয়ে পিছিয়ে আছেন। এসব যত বেশি ভাববেন, তত আপনার অভিজ্ঞতা ও ট্যালেন্টের উপর সন্দেহ আসতে থাকবে। নিজের কমতি বেশি নজরে আসবে। তাই এসব ভাবা যাবে না।
আপনি এই পজিশনে আছেন মানে আপনাকে প্রতিষ্ঠান যোগ্য ভেবেই এখানে বসিয়েছে। আপনার অবশ্যই এমন কিছু স্কিল আছে যেটা কোম্পানিতে ভ্যালু ক্রিয়েট করবে। তাই এসব এলোমেলো চিন্তার ট্র্যাপে নিজেকে একবারেই ফেলা যাবে না। শুধু যে দায়িত্ব আপনি পেয়েছেন, সেটা পূরণ করতে যা যা করা প্রয়োজন সেগুলো করুন।
৩) আমি এভাবেই সব সময় কাজ করি
কর্মক্ষেত্রে বা ব্যবসায় এই কথাটা বলা এক ধরনের বিপদই বলা যায়। রেগুলার রুটিনে কাজ করতে যেয়ে এই কথা বলা যায়, কিন্তু কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট করার সময় এসব কথা সব সময় না বলাই ভালো। তাই কিছু কিছু সময় এই কথা বলা যাবে না। সবার সময় ও শিডিউল অনুযায়ী কাজ ম্যানেজ করার চেষ্টা করতে হবে। এই বাস্তব জীবনে নানা সময় নানা সমস্যা হতে পারে। তাই কোন কাজ কখন দরকার হয়ে পড়ে কেউ জানে না। তাই সুযোগ বুঝে সবকিছু শিখে রাখাই ভালো।
আপনাকে হয়ত অফিস থেকে নতুন কোনো কাজ দেয়া হয়েছে যেটা শিখতে আপনার সময় লাগবে। কিন্তু আপনি সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য রেখে দিয়ে, সময়মতো কাজটা না শিখে প্রজেক্ট জমা দিতে পারলেন না। আপনাকে এর কারণ দর্শাতে বললে সেটাতেও আপনি আগ্রহ দেখালেন না। সবশেষে জানালেন, ‘আমি এভাবেই কাজ করি’। তখন কী হবে জানেন? আপনি অন্যদের মাঝে ব্ল্যাকলিস্টে পড়ে যাবেন। আপনাকে জানা হবে এমন ব্যক্তি হিসেবে, যিনি আসলে সময়ের কাজ সময়ে করেন না। এতে আপনার কোনো লাভ তো নেইই, বরং ক্যারিয়ারে বেশ বড় একটা আঘাত এটি। তাই এই কাজ কখনোই করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই চেষ্টা করতে হবে সব সামলে নেয়ার। এতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আপনিই থাকবেন।
৪) আমার কোনো গুরুত্ব নেই
আপনি যখন কোনো টিমে কাজ করছেন, সেটা যে ডিপার্টমেন্টই হোক না কেন, এর মানে হচ্ছে সেটা অবশ্যই কোম্পানির একটি অংশ, আর সেই অংশটা বাদ থাকা মানে হচ্ছে গাছ ছাড়া বোনের মতো। তাই আপনি যে কাজ করছেন কোম্পানির জন্য, সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়ত শুধু আপনার কাজটুকুই দেখছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না, আপনার এই কাজটুকুই কোম্পানির জন্য কতখানি অবদান রাখছে। এটা বুঝতে পারেন না বলেই কখনো কখনো আপনার মনে হতে পারে, আপনার কাজের কোনো ভ্যালু নেই, সবই পয়েন্টলেস। আপনি কী কী ইমপ্যাক্ট রাখছেন কোম্পানির জন্য, সেটা কখনোই বুঝতে পারেন না।
সব সময় মনে রাখবেন, কোম্পানির প্রতিটি কর্মী একেকটি পাজলের মতো। যত যাই হোক না কেন, আপনার কাজটুকুও কোম্পানির জন্য অবদান রাখে, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং আপনিও যে কোনো বড় পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারেন।
৫) আমি হারতে চাই না
সত্যি বলতে কেউ আসলে হারতে চায় না। যত যাই হোক, এটা কেউই মানতে পারে না। কিন্তু জীবনে হারজিত থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই আগাতে হবে। আপনি যদি একবার নিজের ভয়কে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে কী হবে জানেন? জীবনে এগিয়ে যাওয়ার যে যাত্রা, সেখানে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন। হেরে যাওয়া আপাত দৃষ্টিতে দেখতে তেমন আনন্দের নয়। বারবার কাজে ভুল করা, এলোমেলো হয়ে যাওয়া, জানা জিনিসও না করতে পারা – এসব সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে থেমে যাবেন। শেষ কথার এক কথা, কখনো চেষ্টা না করার চেয়ে ভুল করে হলেও এগিয়ে যাওয়া ভালো না?
৬) আমি এটা অপছন্দ করি
আপনি কোনো কিছু করতে যেয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখছেন, বর্তমান চাকরিতে কীভাবে আরও এগিয়ে যাওয়া যায় তা ভাবছেন, নতুন নতুন ব্যবসার চেষ্টা করছেন, মানে আপনার সর্বশক্তি দিয়ে আপনি এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। একটা লক্ষ্য সেট করেছেন, অবশ্যই সেটা দারুণ একটা ব্যাপার। আর এসব করতে যেয়ে বারবার বলছেন, ‘এটা আমার ভালো লাগে না, এটা আমার পছন্দ না, এটা আমি ঘৃণা করি।’ আপনি যদি সব সময় ভাবতে থাকেন, ‘আমার কাজকে আমি অপছন্দ করি, আমার সহকর্মীদের আমি পছন্দ করি না, আমার কোম্পানিকেও আমার ভালো লাগে না’ – তাহলে কীভাবে আপনি কর্মক্ষেত্রে ভালো থাকবেন? কীভাবে আপনি আপনার বেস্টটা দিয়ে কোম্পানির জন্য কাজ করবেন? প্রতি মুহূর্তে আপনার বিরক্তি বাড়তে থাকবে। সেই সাথে সব সময় নেতিবাচক কথাবার্তা আপনাকে অন্যদের চোখেও বিরক্তিকর করে তুলবে। তারা ভেবেই বসবে, আপনার কাছে আসলে পজিটিভ কনো কথা নেই, আচরণ নেই। কর্মক্ষেত্রে এমন আচরণ কেউই ভালোভাবে নেয় না। বরং অন্যদের কাছে নিজেকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে।
আপনার যে রেপুটেশন আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এই রেপুটেশনকে কীভাবে ভালো করে তুলবেন, সেটা পুরোটাই আপনার উপর নির্ভর করে। প্রতিষ্ঠানের আয়ত্তে থেকে কীভাবে রেপুটেশন ভালো রাখবেন, কীভাবে কথা বললে অন্যরা কষ্ট পাবে না এসব আপনাকেই ভাবতে হবে। মনে রাখবেন, এটাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, যেখানে আপনি কাজ করবেন। আজ ভালো কাজ করলে সামনে নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে আরও ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারবেন। তাই ক্যারিয়ার গোছানোর জন্য হলেও এই ধরনের আচরণ ও কথাবার্তার দিক থেকে নিজেকে সামলে রাখা উচিত।